পাবদা মাছ আমাদের সবারই পরিচিত এবং পুষ্টিগুণেও মাছটি অনন্য। এ মাছের বাজার মূল্যও ভাল। তাই এটি চাষ করে প্রচুর লাভবান হওয়া যায়।* কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতি উদ্ভাবনের ফলে পাবদা মাছ একক ও রুই জাতীয় মাছের সঙ্গে মিশ্রভাবে চাষ করা সম্ভব। সেই সাথে তেলাপিয়া মাছের সঙ্গেও মিশ্রচাষ করা সম্ভব।অর্থনৈতিক বিবেচনায় মিশ্র পদ্ধতিতে পাবদা মাছ চাষ করা লাভজনক।* পাবদা মাছ আবহমানকাল থেকে বাঙালিদের কাছে খুব প্রিয় এবং পরিচিত একটি মাছ।খেতে সুস্বাদু ও কাঁটা কম থাকায় ছোটদের কাছেও মাছটি প্রিয়।
স্থান নির্বাচন ও পুকুরের বৈশিষ্ট্য* পুকুর রৌদ্র আলোকিত খোলামেলা জায়গায় হাওয়া উত্তম এবং পাড়ে ঝোপ- জঙ্গল থাকলে তা পরিষ্কার করে ফেলতে হবে।* পাড়ে বড় গাছপালা থাকলে সেগুলোর ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে এবং দিনে কমপক্ষে ৮ ঘন্টা রৌদ্রালোক পড়া নিশ্চিত করতে হবে।* ব্যবস্থাপনা সুবিধার জন্য পুকুর আয়তকার হতে হবে।* পুকুরের আয়তন ১৫-২০ শতাংশের মধ্যে হলে ব্যবস্থাপনা করতে সুবিধা হয়। তবে ৫০ শতাংশের অধিক না হওয়াই উত্তম।* পুকুরের গড় গভীরতা ৪-৫ ফুট হলে ভাল হয়, যেখানে বৎসরে ৭-৮ মাস পানি থাকে। তবে সারা বছর পানি থাকে অর্থাৎ অন্য মাছের চাষ (পুরোনো পুকুর) হচ্ছে এমন পুকুরে পাবদা মাছ চাষ করা আরো ভালো।* পুকুরের তলদেশ সমতল ও পচাঁ কাদা মুক্ত হতে হবে।* বন্যামুক্ত ও বসতবাড়ীর আশে পাশে।
পুকুর প্রস্তুতি* পুকুরের পাড় মেরামত করতে হবে।* প্রথমে পুকুরকে সেচের মাধ্যমে শুকিয়ে ফেলা প্রয়োজন।* পুকুর শুকানো সম্ভব না হলে প্রতি শতাংশে প্রতি ফুট গভীরতার জন্য ১৮-২৫ গ্রাম রোটেনন পাউডার দিয়ে সব ধরনের মাছ অপসারণ করা যায়।* পুকুরের তলায় কাদা হওয়ার বেশি সম্ভাবনা থাকলে হালকা করে কিছু বালি (দালান-কোঠা নির্মাণের জন্য যে বালু ব্যবহৃত হয়) ছিটিয়ে দেয়া যেতে পারে। এর ফলে পুকুরের তলায় গ্যাস হবে না, পানি পরিষ্কার এবং পরিবেশ ভাল থাকবে।* রোটেনন প্রয়োগের ২-৩ দিন পর শতাংশ প্রতি ১ কেজি হারে পাথুরে চুন প্রয়োগ করতে হবে। তবে চুন ছাড়াও জিওলাইট (প্রতি শতকে ১ কেজি) পুকুর প্রস্তুতির সময় প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।* উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি তথা প্রাকৃতিক খাদ্যে বৃদ্ধির জন্য সার প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। পুকুর প্রস্তুতির শেষ ধাপে সার প্রয়োগ করা হয়। চুন প্রয়োগের ৪-৫ দিন পর শতকে ৮০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ৪০ গ্রাম টিএসপি সার প্রয়োগ করা হয়।* পুকুরে কোনো প্রকার জৈব সার দেওয়া যাবে না।পোনা মজুদ* পুকুরে পোনা ছাড়ার পূর্বে পরিবহনকৃত পোনা পুকুরের পানির তাপমাত্রার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। এর জন্য ১০ লিটার পানি ও ১ চামচ পটাসিয়াম পারম্যাংগানেট অথবা ১০০ গ্রাম লবণ মিশিয়ে দ্রবণ তৈরি করতে হবে। এরপর তাতে ১-২ মিনিট গোসল করিয়ে পোনা জীবাণুমুক্ত করতে হবে।* সার প্রয়োগের ৪ দিন পর পানির রং সবুজ বা বাদামি হলেই পুকুরে পোনা মজুদ করতে হবে।* যদি সম্ভব হয় পোনা ছাড়ার সময় থেকে ৫-৬ ঘন্টা পুকুরে হালকা পানির প্রবাহ রাখতে হবে।* একক চাষের ক্ষেত্রে শতাংশ প্রতি ৩-৪ গ্রাম ওজনের সুস্থ্য-সবল ২০০-২৫০টি পোনা মজুদ করা যেতে পারে।* মিশ্র চাষের ক্ষেত্রে প্রতি শতাংশে ২ থেকে ৩ ইঞ্চি সাইজের ৫০টি পাবদা, ১০০টি শিং এবং ৪ থেকে ৫ ইঞ্চি সাইজের ৫টি কাতলা , ১০টি রুই , ১০টি মৃগেল, ২টি সিলবার কার্প ও ২টি গ্রাস কার্পের সুস্থ পোনা মজুদ করতে হবে।* তেলাপিয়ার সাথে পাবদা মাছ ভাল হয়ে থাকে এ কারণেই যে তেলাপিয়ার অবাঞ্চিত বাচ্চা পাবদা মাছ খেয়ে তাড়াতাড়ি বড় হয়।খাদ্য ব্যবস্থাপনা* ৩০% ফিস মিল, ৩০% সরিষার খৈল, ৩০% অটোকুড়া, ১০% ভূষি ও ভিটামিন প্রিমিক্স সহকারে সম্পূরক খাবার তৈরি করা যায় অথবা বাজারের কৈ মাছের ফিড খাওয়ালেও চলবে।* এরা সাধারণত রাতে খেতে পছন্দ করে। তাই উপরোল্লিখিত খাবারটি রাতে ২ বার প্রয়োগ করা যেতে পারে। মিশ্র চাষের ক্ষেত্রে অন্যান্য মাছের জন্য স্বাভাবিক নিয়মে খাবার দিতে হবে।* পোনা মজুদের পরের দিন থেকে মাছকে তার দেহ ওজনের ১২ ভাগ থেকে আরম্ভ করে দৈনিক খাবার দিয়ে যেতে হবে।* প্রতি ১৫ দিন অন্তর খাদ্য প্রয়োগের হার ১% করে কমাতে হবে।* পাবদা মাছের ওজন ৩০ গ্রামের উর্ধ্বে উঠলে খাদ্য প্রয়োগের পরিমাণ হবে তার দেহ ওজনের শতকরা ৫ ভাগ।রোগ বালাইপাবদা মাছের পেট ফোলা রোগ: সাধারণত পুকুরের তলদেশে অতিরিক্ত জৈব পদার্থ জমা হয়ে গেলে, অধিক ঘনত্বে মাছ মজুদ করলে, পানির পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেলে এই রোগ দেখা দেয়।লক্ষণ: মাছের পেট ফুলে যায়, ফোলা অংশে চাপ দিলে পায়ু দিয়ে পানি জাতীয় তরল বের হয়, চাপ দিলে ফোলা অংশের ভিতর গ্যাস বা তরল কিছু অনুভূত হয়। এই রোগে মাছের মৃত্যু ঘটে থাকে।প্রতিকার: প্রতি কেজি খাবারের সাথে ৫ গ্রাম অক্সিটেট্রাসাইক্লিন (বাজারে টেট্রাভেট নামে পাওয়া যায়), ১ গ্রাম ভিটামিন সি ও ২ গ্রাম লেসিফস মিশিয়ে ৩ থেকে ৫ দিন খাওয়াতে হবে।
পাবদা মাছের ক্ষত রোগ:* রোগাক্রান্ত মাছ পুকুর থেকে তাৎক্ষণিকভাবে তুলে ফেলতে হবে।* ১০ লিটার পানিতে ১০০ গ্রাম লবণ গুলে লবণমিশ্রিত পানিতে রোগাক্রান্ত মাছ পাঁচ থেকে দশ মিনিট ডুবিয়ে রেখে অত:পর পুকুরে ছেড়ে দিতে হবে।* ক্ষত রোগে আক্রমণের আগেই প্রতি বছর আশ্বিন মাসের শেষে কিংবা কার্তিক মাসের প্রথম দিকে পুকুরে শতাংশ প্রতি ১ কেজি হারে পাথুরে চুন ও ১ কেজি হারে লবণ প্রয়োগ করা হলে সাধারণত আসন্ন শীত মৌসুমে ক্ষত রোগের কবল থেকে মাছ মুক্ত থাকে।* এ রোগ নিরাময়ের জন্য ৭-৮ ফুট গভীরতায় প্রতি শতাংশ জলাশয়ে ১ কেজি হারে পাথুরে চুন ও ১ কেজি হারে লবণ প্রয়োগ করা হলে আক্রান্ত মাছ দুই সপ্তাহের মধ্যেই আরোগ্য লাভ করে।
অন্যান্য ব্যবস্থাপনা* পুকুরের পানি ভালো রাখার জন্য ১৫ দিন পর পর হররা টেনে দিতে হবে।* চাষকালীন সময়ে শামুকের আধিক্য পরিলক্ষিত হলে শতাংশ প্রতি ১০০-২০০ গ্রাম ইউরিয়া প্রয়োগে শামুকের আধিক্য কমবে।* অ্যামোনিয়া গ্যাস দূর করার জন্য অ্যামোনিল (প্রতি একরে ২০০ মি.লি.) ব্যবহার করতে পারেন।* ১৫ দিনে একবার নমুনা সংগ্রহ করে গড় বৃদ্ধির সাথে সঙ্গতি রেখে মোট খাদ্যের পরিমাণ ঠিক করে নিতে হবে।* ক্ষত রোগ থেকে মাছকে মুক্ত রাখতে প্রতি মাসে একবার পুকুরে জিওলাইট অথবা চুন দিতে হবে (শতকে ২০০ গ্রাম)।* মাছ নিয়মিত খাবার খায় কিনা সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।* গ্রীষ্মকালে অনেক সময় পুকুরের পানি কমে যায় এবং তাপমাত্রা বেড়ে যায়। তখন অনেক সময় পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়। এরকম পরিস্থিতিতে খাবার প্রয়োগ কমিয়ে দিতে হবে।* একটানা মেঘলা আবহাওয়ায় কিংবা অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে অথবা একেবারে বন্ধ করে দিতে হবে।* প্রতি ১৫ দিনে একবার প্রোবায়োটিক ব্যবহার করলে মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে ও পানির পরিবেশ ভাল থাকবে।* এক পুকুরের জাল অন্য পুকুরে ব্যবহারের আগে ভাল পানির সাথে জিবাণু নাশক পটাশ মিশিয়ে পরিষ্কার করে নিন।* অনেক সময় বক, মাছরাঙা, জলজ পাখি থেকে রোগ জীবাণুর সৃষ্টি হয়। তাই পুকুরের চারদিকে রঙিন ফিতা টানিয়ে দিন।
আহরণ ও বিক্রয়: ৭ থেকে ৮ মাস পর মাছ ৭০ থেকে ৮০ গ্রাম ওজনের হলে আহরণ করা যেতে পারে। ***
বিস্তারিত জানার জন্য আপনার নিকটস্থ উপজেলা মৎস্য দপ্তরে যোগাযোগ করুন।